অক্টোবর ২০২০ থেকে জুন ২০২২ পর্যন্ত দেড় বছরে নগরীতে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা এবং অভিযোগে শিশু আইনে ৩২৯টি মামলা নিয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) ১৬ থানা। এর মধ্যে আসামি করা হয়েছে ৪০৪ জনকে। আদালতের প্রক্রিয়া শেষে শিশু-কিশোর সংশোধনাগার কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে ৩২৩ জনকে। সে সব ঘটনায় বিচারাধীন আছে ১০৪টি মামলা। যার মধ্যে রয়েছে মারামারি, চুরি-ছিনতাই, মাদক মামলাসহ হত্যা মামলাও। ১৮ বছরের নিচে গ্রেফতারকৃত অভিযুক্ত এইসব কিশোরদের শিশু অপরাধ আইনের বিবেচনায় শিশু-কিশোর সংশোধনাগার কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন আদালত।
এর আগে এতো বিস্তর কিশোর অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার নজির নেই সিএমপিতে। এমনটাই অভিমত সংশ্লিষ্টদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র এই প্রতিবেদককে জানান, সিএমপিতে যোগদানের পর কমিশনার মহোদয় কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে শক্ত ভূমিকা রাখবেন বলে সাংবাদিকদের কথা দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর কথা রেখেছেন।
২০২০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে যোগ দেওয়ার ৩ দিন পর ১০ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ এবং মত-বিনিময় করেন কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর। মত-বিনিময় সভায় কমিশনারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণের অনুরোধ জানান সাংবাদিকরা। কমিশনারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বেসরকারি টেলিভিশন দীপ্ত টিভির ব্যুরো প্রধান রুনা আনসারী বলেন, অলিতে গলিতে যে হারে কিশোর গ্যাংয়ের বিচরণ বাড়ছে তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে শিশুদের ভবিষ্যত হুমকির মুখে পড়বে।
সেসময় উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর বলেছিলেন, শুধু কিশোর গ্যাং নয়-সব ধরনের অপরাধই শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। আমি কথায় বিশ্বাসী নই, কাজে বিশ্বাসী। আপনারা আমার কাজ দেখে বিচার করবেন।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর এই ৩ মাসে ১৮ বছরের নীচে শিশু আইনে মামলা হয়েছে ৫৬টি। যার মধ্যে আসামি ৭৮ জন। বিচারাধীন রয়েছে ২৫টি মামলা। গ্রেফতারের পর আদালতের মাধ্যমে শিশু-কিশোর সংশোধনাগার কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে ৬১ জনকে।
২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ- এই ৩মাসে মামলার সংখ্যা ছিল ৩৫টি, আসামি ৪৭ জন আর বিচারাধীন মামলা রয়েছে ৪টি। শিশু-কিশোর সংশোধনাগার কেন্দ্রে পাঠানো হয় ১৬ জনকে।
এপ্রিল থেকে জুন-এই ৩ মাসে মামলা সংখ্যা ৪৫টি, আসামি সংখ্যা ৬৭, বিচারাধীন মামলা আছে ৮টি, সংশোধনাগার কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে ৫৫ জনকে।
জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর- এই ৩মাসে মামলার সংখ্যা ৬০টি আর আসামির সংখ্যা ৭১ জন। বিচারাধীন মামলা ১৫টি আর শিশু-কিশোর সংশোধনাগার কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে ৫১ জনকে।
একই বছর অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর – এই ৩মাসে মামলা সংখ্যা ছিলো ৬৩টি, আসামি সংখ্যা ৯৪ জন, বিচারাধীন মামলা ২৭টি, শিশু-কিশোর সংশোধনাগার কেন্দ্রে পাঠানো হয় ৮৮জনকে।
চলতি বছরের (২০২২) জানুয়ারি থেকে মার্চ এই ৩ মাসে মামলার সংখ্যা ৩৯টি, আসামি ৬৫ জন, বিচারাধীন মামলা ১৯ টি। সংশোধনী কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে ৩৫ জনকে।
গত এপ্রিল থেকে জুন -এই ৩ মাসে মামলা সংখ্যা ৩১টি, আসামি সংখ্যা ৫৩ জন, বিচারাধীন মামলা ৪টি, শিশু-কিশোর সংশোধনাগার কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে ১৭ জন শিশু-কিশোরকে।
আরও পড়ুন : নবীন ওসির জয়জয়কার সিএমপিতে, ১৬ থানার ১৩ টিতেই নবীন
অন্যান্য যে কোনো সময়ের চেয়ে কিশোর গ্যাং কালচার নিয়ন্ত্রণে বর্তমান কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর অনেক বেশি সক্রিয় ছিলেন বলে জানান সাংবাদিক রুনা আনসারী। সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর সাংবাদিকদের কাছে দেওয়া কথা রেখেছেন বলে কমিশনারের প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানান তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২১ মাসে ৩২৯টি মামলা এবং ৪০৪ জনকে গ্রেফতার-সংখ্যা বিবেচনায় সফল হলেও আমি চাই মামলা কিংবা গ্রেফতার নয় বরং এই সংখ্যা কমে আসুক অপরাধ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে।
শিশু-কিশোরদের সংশোধনে পারিবারিক কাউন্সিলিং জরুরি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, কিশোর গ্যাং কালচার নিয়ন্ত্রনে পরিবার অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
আরও পড়ুন : ‘আমার গাড়ি নিরাপদ’ অ্যাপস কমিয়েছে শঙ্কা, দিয়েছে স্বস্তি!
মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী জিয়া হাবিব বলেন, শিশু আইনের বেশ কিছু প্রভিশন রয়েছে সেগুলোর বাস্তবায়ন জরুরি।
চট্টগ্রামে কোনো শিশু সংশোধনাগার নাই বলে দুঃখ্য প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রাম কারাগার থেকে শিশু-কিশোরদের সংশোধনের জন্য গাজীপুরের একটি সংশোধনাগারে পাঠানো হয়। সেখানে সংশোধনের চেয়ে শিশু-কিশোররা আরও বেশি অপরাধ প্রবণ হয়ে ওঠে। চট্টগ্রামেও একটি আধুনিক কিশোর-কিশোরী সংশোধনাগার তৈরি করার দাবি জানান এই মানবাধিকার কর্মী।
আরও পড়ুন : এই জাদুঘর মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিবে
জানতে চাইলে সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর এই প্রতিবেদককে বলেন, সিএমপিতে যোগদানের পরই সবাইকে বলেছিলাম, অপরাধ যে করবে সে ‘আনটাচেবল’ থাকবে না। সে যেই হোক আর যে কোনো বয়সেরই হোক। আমি আমার কথা রেখেছি।
কিশোর গ্যাং সম্পর্কে তিনি বলেন, ওদের গ্রেফতার করে খুব একটা লাভ যে হয় তা কিন্তু না। অপরাধীদের সাথে মিশে ওদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা আরও বেড়ে যায়।
চট্টগ্রামে শিশু-কিশোরবান্ধব ভালো একটা সংশোধনাগার জরুরি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, এই বিষয়ে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে খুব বেশি দেরী হয়ে যাবে।
কিশোর অপরাধ বাড়ার কারণ হিসেবে পারিবারিক সম্পর্ককে দায়ী করে তিনি আরও বলেন, সন্তানদের প্রতি আমাদের আরও যত্নশীল হতে হবে।
এমজে/